উহুদ যুদ্ধের ইতিহাস | battle of uhud | islamic post

উহুদ যুদ্ধের ইতিহাস | battle of uhud 

উহুদের যুদ্ধ

islamic post | bangla hadis 

উহুদ যুদ্ধের ইতিহাস | islamic post | bangla hadis

উহুদ যুদ্ধ মহানবী (স)-এর মদীনা জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষামূলক যুদ্ধ। এ যুদ্ধের প্রতিটি পদক্ষেপ ও পর্যায় মুসলিম জাতির জন্য শিক্ষণীয় ঘটনা হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।


উহুদ যুদ্ধে কুরাইশদের মদীনা অভিযান :

হিজরি তৃতীয় বর্ষে কুরাইশ কাফেররা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে তিন হাজার সশস্ত্র সৈন্য নিয়ে মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হলো। এ সৈন্যদের মধ্যে ৭০০ বর্মধারী সৈনিক এবং ২০০ জন অশ্বারোহী সৈনিক ছিল। বহু নারীও তাদের স্বামীর সাথে এ অভিযানে অংশগ্রহণ করে। দশদিন ধরে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার পর কুরাইশ বাহিনী মদীনা থেকে পাঁচ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত আকিক উপত্যকায় উপনীত হয়। অতঃপর ২১ মার্চ ৬২৫ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে শিবির স্থাপন করে।


পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ উহুদ পাহাড় মদীনা শহরের উত্তরাংশে অবস্থিত। শহর থেকে বরাবর এ পাহাড়ের মধ্যবর্তী একটি অর্ধবৃত্তাকার বক্র স্থান ছিল। এটা এত প্রশস্ত ছিল যে, অনায়াসে কয়েক সহস্র লোকের স্থান সঙ্কুলান হতো। পাহাড়ের আরও গভীরাংশে অনুরূপ আরও একটি প্রশস্ত উন্মুক্ত স্থান ছিল এবং একটি সংকীর্ণ পথ দ্বারা এ দুটি স্থান সংযুক্ত ছিল। উহুদ পাহাড়ের দক্ষিণাংশ দিয়ে ওয়াদীকানাত প্রবাহিত হয়েছে এবং এটার দক্ষিণে রয়েছে আইনায়েন পাহাড়। উহুদ যুদ্ধের দিন রসূলে করীম (স) আইনায়েন পাহাড়ে মুসলিম বাহিনীর তীরন্দাজদের সমবেত করেন বলে এ পাহাড়কে ছবল-আল-রুমত বা তীরন্দাজদের গিরি বলা হয়ে থাকে। এটার প্রশস্ত পাদদেশ দিয়ে দুটি নির্ঝরিণী প্রবাহমান।


মদীনায় রাসূল সা. এর উহুদ যুদ্ধের প্রস্তুতি :

হযরত মুহম্মদ (স) কুরাইশদের মদীনা অভিযানে রওয়ানা হওয়ার সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শত্রুদের প্রতিরোধ করার জন্য উপযুক্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তিনি শহরের অভ্যন্তরভাগ থেকেই কুরাইশদের আক্রমণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করছিলেন। তিনি তাঁর পরিকল্পনা সাহাবীগণকে অবহিত করলেন। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর অত্যুৎসাহী তরুণ যোদ্ধারা অগ্রসর হয়ে শত্রুসৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার অভিলাষ প্রকাশ করেন। তাঁদের উদ্দীপনাকে অধিকাংশ সাহাবী সমর্থন করেন। হযরতের নিকট তা সঙ্গত মনে না হলেও তিনি অধিকাংশের অভিমতের ওপর সম্মতি প্রদান করেন।

আরো পড়ুন>> যে যুদ্ধের ইতিহাসে এখনো মানুষ আশ্চর্য 


এরপর শুরু হয় উহুদ অভিমুখে যাত্রা। মহানবী (স)-এর সঙ্গে নিকট তা সঙ্গত মনে না হলেও তিনি অধিকাংশের অভিমতের ওপর সম্মতি ১০০০ সৈন্য যোগ দেন। বদরের তুলনায় তাঁরা ছিলেন সশস্ত্র এবং অভিজ্ঞ। তাছাড়া বদরে বিজয়ের গৌরবময় স্মৃতি তাদেরকে দারুনভাবে উজ্জীবিত করে

রেখেছিল।


উহুদ যুদ্ধে ইবনে উবাইয়ের বিশ্বাসঘাতকতা :

মদীনা সনদ অনুসারে মদীনার বিরুদ্ধে সকল আক্রমণ সনদভুক্ত সকলের সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করার কথা। সে অনুসারে ৩০০ অনুচরসহ আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয় এবং কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মদীনা থেকে বের হয়। কিছুদূর যাওয়ার পর ইবনে উবাইয়া তার ৩০০ অনুচর নিয়ে মুসলিম বাহিনী থেকে সরে দাড়ায়।

আরো পড়ুন>> লোভের ভয়াবহ পরিনাম জানলে বিস্মিত হবেন


সে যুক্তি দেখায়, সনদে মদীনা আক্রমণ করলে তা প্রতিরোধের কথা ছিল। মদীনা থেকে বাইরে গিয়ে কাউকে আক্রমণ করার কথা ছিল না। মহানবী (স) এ আশঙ্কা করেছিলেন বলে পূর্বেই মদীনার ভেতর থেকে ইবনে উবাইয়ের আক্রমণ প্রতিরোধের পরিকল্পনা করেছিলেন। বিশ্বাসঘাতকতার জন্য যুদ্ধ শুরুর আগেই মুসলিম বাহিনী একটি বিপর্যয়ের শিকার হলো । তারা মনে মনে অনেকখানি দমে গেলেন।


উহুদ যুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী :

উহুদ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে প্রথমবারের মতো নারীগণ অংশগ্রহণ করেন। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সহধর্মিণী হযরত আয়শা (রা) এবং আরও কতিপয় নারী স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধের ময়দানে শত বিপদ উপেক্ষা করে উহুদের লড়াইয়ে হযরত আয়শা (রা) ও নারী সেচ্ছাসেবকগণ আহত সৈনিকদের সেবা করেন, তাদের পিপাসা নিবারণের জন্য পানি যোগান এবং যুদ্ধের পক্ষে অপরিহার্য আরও অনেক কাজ করে দেন।


battle of uhud


উহুদ যুদ্ধে শিবির স্থাপন :

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে বালুকাময় প্রশস্ত সমতল ভূমিতে এসে পৌঁছলেন। পরবর্তী দিবস তিনি পাহাড়ের অর্ধবৃত্তাকার বক্রাংশে প্রবেশ করে তার অভ্যন্তর ভাগের উন্মুক্ত স্থানে শিবির স্থাপন করলেন।


উহুদ যুদ্ধে গিরিপথে পাহারা :

পাহাড়ের বৃত্তাকার অংশের বহির্ভাগ থেকেই তিনি। যুদ্ধ চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং সেভাবে তীরন্দাজদের ৫০টি ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করে আইনায়েন পাহাড়ের শীর্ষদেশে মোতায়েন করেন। পশ্চাদ্দেশ হতে কুরাইশরা যাতে যুদ্ধে নিয়োজিত মুসলিম বাহিনীর প্রধান অংশের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালতে না পারে, সেই জন্য হযরত মুহাম্মদ (স) তীরন্দাজ বাহিনী এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরের নেতৃত্বে ক্ষুদ্র অশ্বারোহী দলের ওপর উহুদ ও আইনায়েন পাহাড়ের মাধ্যবর্তী সংকীর্ণ পথ রক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত করেন।

আরো পড়ুন>> কোরআনে বর্ণিত ইব্রাহিম আ. এর ঘটনা


হযরত মুহাম্মদ (স) আইনায়েন পাহাড়ের তীরন্দাজ বাহিনীকে কোনো অবস্থাতেই তার সুস্পষ্ট নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত স্থান ত্যাগ করতে নিষেধ করেন। তিনি এমনও বলেন, যদি দেখ আমরা পরাজিত হয়েছি, আমাদের শবদেহ পশু-পাখি ভক্ষণ করছে তারপরও আমার নির্দেশ ছাড়া তোমরা এ স্থান ত্যাগ করবে না।


উহুদ যুদ্ধে সংঘর্ষ ও প্রাথমিক বিজয় :

২১ মার্চ (মতান্তরে ২৬ মার্চ) উহুদ যুদ্ধ শুরু হয়। মুসলমানদের উপস্থিতির সংবাদ পাওয়ার পর কুরাইশরা তাদের প্রধান পদাতিক বাহিনী এবং ইকরিমা ১০০ সৈন্য দ্বারা গঠিত অশ্বারোহী দলের অর্ধাংশ নিয়ে সম্মুখ ভাগ হতে মুসলিম বাহিনীর দিকে ধাবমান হয় এবং মুসলমানদের ওপর পশ্চাৎদিক হতে আক্রমণের জন্য খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে তাদের অশ্বারোহী দলের অপর অর্ধাংশ প্রেরণ করে। উভয় দল সম্মুখ- সমরে অবতীর্ণ হয়। প্রথামাফিক মল্লযুদ্ধ দিয়ে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ যুদ্ধে দুর্ধর্ষ আরব যোদ্ধা তালহা মহাবীর হযরত হামযা (রা)-এর নিকট পরাজিত ও নিহত হয়। এরপর সাধারণ যুদ্ধ শুরু হয়। প্রথমদিকে মুসলিমবাহিনী একের পর এক জয়লাভ করতে থাকে।


উহুদ যুদ্ধে বিশৃঙ্খলা :

কুরাইশ বাহিনী বিপুল বিক্রমশালী মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে পুরোপুরি পর্যুদস্ত হয় এবং পালাতে শুরু করে। মুসলিম বাহিনী কুরাইশদের পরাজয় পুরোপুরি নিশ্চিত না করে মহানবী (স)-এর সতর্কবাণী ভুলে গিয়ে শত্রুশিবির লুণ্ঠন এবং তাদের যুদ্ধাস্ত্র হস্তগত করার কাজে লিপ্ত হয়।


মূল বাহিনীর এ কাজ দেখে গিরিপথ পাহারায় নিয়োজিত তীরন্দাজ ও অশ্বারোহীগণ ভাবলেন, চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছে। মহানবী (স)-এর নিষেধাজ্ঞা ভুলে গিয়ে এবং তাদের নেতা আব্দুলাহ ইবন যুবাইরের নিষেধ অমান্য করে মূল বাহিনীর সঙ্গে তারাও কুরাইশদের শিবির দখল এবং অস্ত্র-শস্ত্র লুণ্ঠনে যোগ দেয়। এতে মুসলিম বাহিনীর শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়। পেছন থেকে তারা পুরোপুরি অরক্ষিত হয়ে পড়ে।


উহুদ যুদ্ধে খালিদের আক্রমণ :

খালিদ বিন ওলীদ তখন কুরাইশ অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধান সেনাপতি। তিনি দূরদর্শী এবং সমরকুশলী ছিলেন। মুহূর্তেই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা বুঝে ফেললেন এবং পালিয়ে যাওয়ার ভান করে অরক্ষিত গিরিপথে হামলা চালালেন।

আরো পড়ুন>> কোরআনে বর্ণিত আদম আ. এর ইতিহাস


আব্দুল্লাহ ইবন যুবাইর (রা) ও তাঁর অনুসারী কয়েকজন প্রাণপণে তাঁকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। তাঁদেরকে শহীদ করে খালিদ তাঁর অশ্বারোহী দল নিয়ে ছত্রভঙ্গ মুসলিম সৈন্যদের ওপর পেছন দিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।


উহুদ যুদ্ধে সাময়িক পরাজয় :

পেছন দিক থেকে প্রবল আক্রমণে মুসলিম বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ল। সামনের যে সকল কুরাইশ সৈন্য পালিয়ে গিয়েছিল খালিদের হামলার পর তারাও ফিরে এল এবং হামলা শুরু করলো। দ্বিমুখী হামলায় হঠাৎ করেই নিশ্চিত বিজয় পরাজয়ে পর্যবসিত হলো। অনেক মুসলিম সেনা উপায়ান্তর না দেখে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করতে লাগলেন।


হযরত মুহাম্মদ (স) পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আক্রান্ত সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিলেন। তিনি নিশ্চিতভাবে জানতেন, বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরে এলে এ অবস্থা থেকেও কুরাইশ বাহিনীকে পরাজিত করা সম্ভব।


কিন্তু মহানবী (স) নিদারুন এই দুঃসময়ে বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজ শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই কুরাইশ গোত্রের ইবনে কামিয়া তাঁর ওপর প্রচণ্ড বেগে পাথর ছুঁড়ে মারে। এতে মহানবী (স)-এর সম্মুখভাগের দুইটি দাঁত শহীদ হয়ে যায়। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং কিছুক্ষণের জন্য সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। ইতোমধ্যে মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহক হযরত মুসআব (রা) শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর আকৃতি কিছুটা হযরত রাসূল (স)-এর মতো ছিল। এ কারণে কাফিররা গুজব রটিয়ে দেয়, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) নিহত হয়েছেন। এতে মুসলিম বাহিনী আরও হতোদ্যম হয়ে পড়ে।


উহুদ যুদ্ধে কুরাইশদের বীভৎসতা :

আহত মহানবী (স) কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে পান এবং যথারীতি যুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদান করেন। হযরত আবূ বকর, হযরত আলী (রা)সহ বিশিষ্ট ১১জন সাহাবী তাঁদের জীবন বিপন্ন করে মানব ব্যুহ রচনা করে আহত মহানবী (স)-কে নিয়ে উহুদ পাহাড়ে আরোহন করেন। কুরাইশরা মহানবী (স) নিহত হয়েছেন এবং তাঁর বাহিনী পরাজিত হয়েছে জেনে মহানন্দে ময়দান ত্যাগ করে। এর আগে তারা শহীদ মুসলিমদের নাক ও কান কেটে ছিদ্র করে মালা গেঁথে চরম বীভৎসতার পরিচয় দেন।


আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা হযরত হামযা (রা)-এর হৃদপিণ্ড চিবিয়ে অমানুষিক পৈচাশিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।


উহুদ যুদ্ধ দ্বিতীয় বদর :

উহুদ যুদ্ধ শেষে ময়দান ত্যাগের পর আবু সুফিয়ান জানতে পারে মহানবী (স) নিহত হননি। তখন সে বদর প্রান্তরে মহানবী (স)- এর সাথে মোকাবেলার জন্য অগ্রসর হয়। ইতোমধ্যে মহানবী (স) সাহাবী (রা)-গণকে সংঘবদ্ধ করে ফেলেন।


গিরিপথ ছেড়ে দেওয়ার মাশুল এবং নিজেদের ভুলের সংশোধন করার জন্য তাঁরা মহানবী (স)-এর নেতৃত্বে আহত সিংহের ভয়ঙ্কর ক্ষিপ্রতা নিয়ে বদর অভিমুখে যাত্রা করেন। মহানবী (স)-এর নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দলটি দেখেই আবু সুফিয়ান ও তার বাহিনী ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা অতি দ্রুত ময়দান ছেড়ে মক্কা পালিয়ে যায়। ইতিহাসে এ অভিযানটি দ্বিতীয় বদর হিসেবে গণ্য।


***ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক, ফলো ও শেয়ার করুন এবং আপনার মূল্যবান মন্তব্যটি করে আমাদের পাশে থাকুন। ধ্যন্যবাদ***

Leave a Reply