কোথা থেকে আসলো কুরবানীর বিধান? | হযরত ইবরাহীম আ. এর কুরবানী | kurbanir History

কোথা থেকে আসলো কুরবানীর বিধান? | হযরত ইবরাহীম আ. এর কুরবানী | kurbani   History

 

হযরত ইবরাহীম আ. এর কুরবানী

আমরা কুরবানী সম্পর্কে সকলে জানি যে, কুরবানী শুরু ও সূচনা হযরত আদম আ.-এর পুত্রদ্বয় হাবিল কাবিল থেকেই হয়েছিল। কিন্ত আমাদের এ কুরবানীর সম্পর্ক হযরত ইবরাহীম আ.-এর পুত্র কুরবানীর অবিস্মরণীয় ঘটনার সাথে। আর সে ঘটনার স্মারক হিসেবেই উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর কুরবানী ওয়াজিব করা হয়েছে। হযরত ইবরাহীম আ.-এর সে ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজীরবিহীন, অবিস্মরণীয় ও শিক্ষণীয় ঘটনা। কুরবানীর তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য বুঝবার জন্য এ ঘটনাই হলো একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু।

 

হযরত ইবরাহীম আ. জীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়ে দেন নিঃসন্তান। অবস্থায়। অবশেষে তার বয়স যখন ৮৬ বছর তখন একদিন তিনি আল্লাহ তাআলার কাছে দু’আ করলেন:

رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ

“পরওয়ার দেগার! আমাকে সৎ পুত্র সন্তান দান কর।” (সূরা সাফ্ফাত: ১০০)

তার এ দুআ কবুল হয় এবং আল্লাহ তাআলা তাকে এক পুত্রের সুসংবাদ দেন। ইরশাদ হচ্ছে: “অতঃপর আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।” (সূরা সাফাত: ১০১)

সহনশীল বলে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এ নবজাত তার জীবনে সবর ধৈর্য ও সহনশীলতার এমন পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করবে যার দৃষ্টান্ত দুনিয়ার কেউ কোনদিন পেশ করতে পারবে না ।

 

বৃদ্ধাবস্থায় ইবরাহীম আ. এর পুত্রলাভ

হযরত ইবরাহীম আ.-এর স্ত্রী হযরত সারা যখন দেখলেন যে, তার গর্ভে কোন সন্তান হচ্ছে না, তখন তিনি নিজেকে বন্ধাই মনে করলেন। এদিকে মিশরের সম্রাট ফিরআউন তার হাজেরা নামী কন্যা, অন্যমতে বাদীকে হযরত সারার খিদমাতের জন্য দান করলেন।

হযরত সারা হাজেরাকে ইবরাহীম আ.- এর খিদমাতের জন্য দিয়ে দিলেন। অতঃপর তিনি তাঁকে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করে নিলেন। এ হাজেরার গর্ভেই এই পুত্র জন্মগ্রহণ করলেন। হযরত ইবরাহীম আ. তার নাম রাখলেন ইসমা’ঈল। অবশ্য হযরত সারার গর্ভে পরবর্তীতে হযরত ইবরাহীম আ.-এর দ্বিতীয় পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেন যার নাম রাখেন তিনি ইসহাক। এ সময় হযরত ইবরাহীম আ.-এর বয়স হয়েছিল একশ’ বিশ বছর ও সারার বয়স হয়ে ছিল নিরানব্বই বছর।

লালন-পালনের দীর্ঘ কষ্ট সহ্য করার পর যখন বিপদে-আপদে কাজেকর্মে সন্তান পিতার পাশে দাঁড়াবার বয়সে পৌঁছল তখন আল্লাহ’র পক্ষ থেকে নির্দেশ হলো,

পুত্রকে কুরবানী করার এ ঘটনাকে কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা এভাবে বর্ণনা করেছেন:

فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعَى قَالَ يُبْنَى إِلى أَرى فى الْمَنَامِ أَنْ أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَا ذَاتَرى قَالَ يابَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللهُ مِنَ الصُّبِرِينَ

“অতঃপর যখন পুত্র পিতার সঙ্গে চলা ফেরার মত বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহীম আ. বললেন, হে আমার পুত্রধন! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে যবেহ করছি। তুমি ভেবে দেখ, কী করবে? সে বললো, হে পিতা! আপনাকে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা আপনি পালন করুন। ইনশা আল্লাহ! আপনি আমাকে সবরকারীদের মধ্যে পাবেন।” (সূরা সাফ্ফাত: ১০২)

এ নির্দেশ ছিল হযরত ইবরাহীম আ.-এর জীবনে এক মহাপরীক্ষা। আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলে স্বপ্নের মাধ্যমে না বলে সরাসরি ইবরাহীম আ.-কে হুকুম দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। কারণ এটাও একটা পরীক্ষা ছিল যে, স্বপ্নের হুকুমের মাঝে মানবমনে বিভিন্ন রকম অর্থ করার যথেষ্ট অবকাশ থাকে। এখানেও ইবরাহীম আ.-এর অন্তরের হালাত যাচাই করা উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু ইবরাহীম আ. কোন রকম ব্যাখ্যার অবকাশ নিলেন না। ছেলেকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলেন যে, আমি তোমাকে স্বপ্নে যবেহ করতে দেখেছি।

তাফসীর বিশারদগণ বলেন, সে সময় হযরত ইসমা’ঈল আ.-এর বয়স হয়েছিল ১৩ বছর। কেউ কেউ বলেন, তিনি সাবালক অর্থাৎ, প্রাপ্ত বয়সে উপনীত হয়েছিলেন।

ইসমা’ঈল আ. জবাব দিলেন:

“হে পিতা! আপনাকে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা করে ফেলুন।” এতে হযরত ইসমা’ঈল আ.-এর বিনয় ও আত্মনিবেদনের পরিচয় তো পাওয়াই যায়, তদপুরি প্রতীয়মান হয় যে, এমন কচি বয়সে আল্লাহ তাআলা তাকে কী পরিমাণ মেধা ও জ্ঞান দান করেছিলেন যে, তিনি হযরত ইবরাহীম আ.-এর স্বপ্নের কথা শুনেই বুঝে ফেললেন যে, নবীর স্বপ্ন সে তো ওহী। তাই তিনি স্বপ্নের জবাবে নির্দেশের কথা বললেন:

افْعَلُ مَا تُؤْمَرُ

হযরত ইসমা’ঈল আ. নিজের পক্ষ থেকে পিতাকে এ আশ্বাসও দিলেন:

سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللهُ مِنَ الصُّبِرِينَ

“ইনশাআল্লাহ! আপনি আমাকে সবরকারীদের মধ্যে পাবেন” (সূরা সাফ্ফাত: ১০২)

এ বাক্যে তিনি “ইনশাআল্লাহ আমাকে সবরকারী পাবেন” না বলে সবরকারীদের মধ্যে পাবেন বলে এদিকে ইশারা করেছেন যে, এ সবরও সহনশীলতা একা আমারই কৃতিত্ব নয়; বরং দুনিয়াতে আরও বহু সবরকারী আছেন। ইনশাআল্লাহ আমিও তাঁদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবো।

এবার পিতা-পুত্র উভয়ে কুরবানীর জন্য প্রস্তুত হলেন। ইরশাদ হচ্ছে: “অতঃপর তাঁরা যখন উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলেন এবং ইবরাহীম আ. তাকে (ইসমা’ঈল) যবেহ করতে শায়িত করলেন।” (সূরা সাফ্ফাত: ১০৩)

এরপর কী হলো, তা এ আয়াতে উল্লেখ করা হয়নি। তাফসীরের কিতাবে উল্লেখ রয়েছে যে, অবশেষে তাঁরা উভয়ে যখন কোরবানগাহে পৌঁছলেন, তখন হযরত ইসমা’ঈল আ. পিতাকে বললেন, পিতা! আমাকে খুব শক্ত করে বেঁধে নিন যাতে আমি বেশি ছটফট করতে না পারি। আপনার পরিধেয় বস্ত্রও শামলে নিন যাতে আমার রক্তের ছিটা তাতে না লাগে। এতে সওয়াব হ্রাস পেতে পারে। এ ছাড়া রক্ত দেখলে আমার মা অধিক ব্যাকুল হবেন। আর আপনার ছুরিটাও একটু ধার দিয়ে নিন এবং তা আমার গলায় দ্রুত চালান। যাতে আমার প্রাণ সহাজে বের হয়ে যায়। কারণ মৃত্যু বড় কঠিন ব্যাপার! আপনি আমার মায়ের কাছে পৌছে আমার সালাম বলবেন। যদি আমার জামা তার কাছে নিয়ে যেতে চান, তবে নিয়ে যাবেন। এতে হয়ত তিনি সান্ত্বনা খুঁজে পাবেন।

এরপর ইবরাহীম আ. পুত্রকে চুমু খেলেন এবং অশ্রুপূর্ণ নেত্রে তাঁকে বেঁধে নিলেন। এবং কাঁৎ করে এমনভাবে শায়িত করলেন যেন কপালের একপাশ মাটি স্পর্শ করে। এরপর তিনি স্বজোরে ছুরি চালানো শুরু করলেন। কিন্ত কাটছে না! এ অবস্থা দেখে ফিরিশতাকুল দু’আ তাসবীহ ও তাহমীদ পাঠসহকারে চিৎকার করে বলতে লাগলো- হে আমাদের প্রভু! হে আমাদের মাওলা! এ বৃদ্ধ ভদ্র লোকটির প্রতি রহম কর এবং ছোট্ট বালকটির জীবন রক্ষা কর। অতঃপর আল্লাহ তাদের প্রার্থনা কবুল করলেন এবং ডাক দিয়ে বললেন:

وَنَادَيْنَهُ أَنْ يَابْرُ هِيمُ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّمْيَا إِنَّا كَذلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلُوا الْمُبِينُ وَفَدَيْنَهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ

“আমি তাঁকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে । আমি এভাবেই পুণ্যবানদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি । নিশ্চয় এটা একটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে যবেহ করার জন্য দিলাম এক মহান জন্তু।” (সূরা সাফ্ফাত ১০৪-১০৭)

হযরত জিবরাঈল আ. এক বেহেশতী দুম্বা নিয়ে উপস্থিত হলেন। অবশেষে তাই কুরবানী করলেন হযরত ইবরাহীম আ.। এ থেকে এলো আমাদের এ কুরবানী। কুরবানীর মূলকথাটা হলো, বান্দার জান-মাল, ইবাদত-বন্দেগী, জীবন-মরণ সবকিছুই আল্লাহ’র হুকুমের সামনে সমর্পণ করা। ইরশাদ হচ্ছে:

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَلَمِينَ

“আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ, সবই রাব্বুল আলামীনের জন্য নিবেদিত।” (সূরা আন’আম: ১৬২)

মোটকথা, আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম আ.-এর সুমহান ত্যাগের আদর্শকে পৃথিবীতে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যই সামর্থ্যবান মু’মিন মুসলমানের ওপর কুরবানী ওয়াজিব (অবশ্য পালনীয়) করেছেন। এ মহান কুরবানী আমাদের সামনে সমাগত। আমরা এখন থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করবো এবং দু’আ করবো যেন আমরা ইবরাহীমী আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে কুরবানী করতে পারি আমিন।

আরো পড়ুন >> হাবিল কাবিলের ঘটনা

 

*** ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক, কমেন্ট, শেয়ার এবং ফলো করে আমাদের সাথে থাকুন। সওয়াবের উদ্দেশ্যে বন্ধুদের নিকট ছড়িয়ে দিন।

Daily Visit –  https://rihulislam.com/

Leave a Reply